০২:৪৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জয়পুরহাটের কালাইয়ে খাস পুকুর থেকে অবৈধভাবে মাছ উত্তোলন

Reporter Name
  • Update Time : ০১:২২:৫১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • / ৩৭ Time View

স্টাফ রিপোর্টার

জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মুড়াইল মৌজার একটি সরকারি খাস পুকুর থেকে অবৈধভাবে মাছ উত্তোলনের অভিযোগে তোলপাড় শুরু হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা বোরহান উদ্দিন ও তার সহযোগীরা ইজারা ছাড়াই পুকুর সেচ দিয়ে প্রায় তিন লাখ ৩০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেছেন।

সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী, মুড়াইল মৌজার জেল নং ৬৮, সাবেক দাগ নং ৩৯৮ খতিয়ানভুক্ত প্রায় ৯৯ শতাংশ জমির এ পুকুরটির ইজারা মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। নতুন কোনো ডাক বা টেন্ডার আহ্বান করা হয়নি। অথচ স্থানীয়দের অভিযোগ, বোরহান উদ্দিন (পিতা আবু বক্কর মন্ডল), ফাহিম (পিতা অজ্ঞাত) এবং নাজমুল (পিতা জালাল উদ্দীন) বৈধ অনুমতি ছাড়াই মাছ তুলে বিক্রি করেন।

রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ও সাংবাদিকদের ম্যানেজের চেষ্টা

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ছাত্রলীগ নেতা বোরহান উদ্দিন বিএনপির কিছু নেতার সহযোগিতায় এ কাজ সম্পন্ন করেন। সাংবাদিকরা বিষয়টি অনুসন্ধান শুরু করলে তিনি একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করে সংবাদ বন্ধ করতে চাপ দেন। অভিযোগ রয়েছে, কৃষ্ণনগর ফকিরপাড়া ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ওয়াদুদ ফকিরকে ব্যবহার করে সাংবাদিকদের অর্থ প্রদানের চেষ্টা করেন তিনি। পরে ওয়াদুদ ফকির সেই অর্থ নিজের কাছে রেখে দেন এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো শুরু হয়।

প্রশাসনের ভূমিকায় প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ইফতেকার রহমান জানান, অভিযুক্ত বোরহান উদ্দিনকে তলব করা হলে তিনি অপরাধ স্বীকার করে মুচলেকা দেন এবং চার হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

কিন্তু এ রকম সমাধানকে স্থানীয়রা দায়সারা মন্তব্য করে বলেছেন, সরকারের বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারিয়ে গেলেও নগণ্য জরিমানায় মামলা নিষ্পত্তি করে দেওয়া আসলে প্রভাবশালীদের প্রশ্রয় দেওয়া। এতে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমা আক্তার জাহান কে একাধিক বার ফোন করা হলে রিসিভ হয়নি, এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া পাওয়া যায় নি ।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত

আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, খাস পুকুর থেকে অনুমতি ছাড়া মাছ উত্তোলন করা একাধিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

• খাস জমি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ১৯৯৭ (সংশোধিত ২০০৪) অনুযায়ী, ইজারা মেয়াদ শেষ হলে জমি বা জলাশয় পুনরায় সরকারের মালিকানায় ফিরে আসে। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি।

• বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ধারা ৪৪১ অনুযায়ী, সরকারি সম্পত্তিতে অবৈধ প্রবেশ ‘অপরাধমূলক অনধিকার প্রবেশ’ হিসেবে গণ্য হয়।

• একই আইনের ধারা ৪৪৭-এ বলা হয়েছে, এ অপরাধের শাস্তি হিসেবে জরিমানা বা এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া যেতে পারে।

• এছাড়া, সরকারের আর্থিক ক্ষতি সাধন করায় এটি দণ্ডবিধি ৪০৬ ও ৪০৯ ধারায় সরকারি সম্পদের অপব্যবহার বা আত্মসাতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

তাদের মতে, মাত্র চার হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া আইন ও ন্যায়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

গ্রামবাসীর দাবি

মুড়াইল গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সরকারি সম্পদ লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত করে আওয়ামী লীগ নেতা বোরহান উদ্দিন, তার সহযোগী ও বিএনপি নেতা ওয়াদুদ ফকিরসহ জড়িত সবার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

একজন গ্রামবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “সরকারি পুকুর থেকে কয়েক লক্ষ টাকার মাছ তুলে বিক্রি করা হলো, অথচ প্রশাসন সামান্য জরিমানা নিয়ে চুপ করে গেল। এটা জনগণের সঙ্গে প্রহসন।”

ঘটনাটি স্থানীয়ভাবে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং আইনের শিথিল প্রয়োগে সরকারি সম্পদ লুট হয়ে যাচ্ছে—এমন অভিযোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে। আইন বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষ মনে করছেন, এই ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের অপব্যবহার ও দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

জয়পুরহাটের কালাইয়ে খাস পুকুর থেকে অবৈধভাবে মাছ উত্তোলন

Update Time : ০১:২২:৫১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

স্টাফ রিপোর্টার

জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মুড়াইল মৌজার একটি সরকারি খাস পুকুর থেকে অবৈধভাবে মাছ উত্তোলনের অভিযোগে তোলপাড় শুরু হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা বোরহান উদ্দিন ও তার সহযোগীরা ইজারা ছাড়াই পুকুর সেচ দিয়ে প্রায় তিন লাখ ৩০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেছেন।

সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী, মুড়াইল মৌজার জেল নং ৬৮, সাবেক দাগ নং ৩৯৮ খতিয়ানভুক্ত প্রায় ৯৯ শতাংশ জমির এ পুকুরটির ইজারা মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। নতুন কোনো ডাক বা টেন্ডার আহ্বান করা হয়নি। অথচ স্থানীয়দের অভিযোগ, বোরহান উদ্দিন (পিতা আবু বক্কর মন্ডল), ফাহিম (পিতা অজ্ঞাত) এবং নাজমুল (পিতা জালাল উদ্দীন) বৈধ অনুমতি ছাড়াই মাছ তুলে বিক্রি করেন।

রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ও সাংবাদিকদের ম্যানেজের চেষ্টা

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ছাত্রলীগ নেতা বোরহান উদ্দিন বিএনপির কিছু নেতার সহযোগিতায় এ কাজ সম্পন্ন করেন। সাংবাদিকরা বিষয়টি অনুসন্ধান শুরু করলে তিনি একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করে সংবাদ বন্ধ করতে চাপ দেন। অভিযোগ রয়েছে, কৃষ্ণনগর ফকিরপাড়া ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ওয়াদুদ ফকিরকে ব্যবহার করে সাংবাদিকদের অর্থ প্রদানের চেষ্টা করেন তিনি। পরে ওয়াদুদ ফকির সেই অর্থ নিজের কাছে রেখে দেন এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো শুরু হয়।

প্রশাসনের ভূমিকায় প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ইফতেকার রহমান জানান, অভিযুক্ত বোরহান উদ্দিনকে তলব করা হলে তিনি অপরাধ স্বীকার করে মুচলেকা দেন এবং চার হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

কিন্তু এ রকম সমাধানকে স্থানীয়রা দায়সারা মন্তব্য করে বলেছেন, সরকারের বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারিয়ে গেলেও নগণ্য জরিমানায় মামলা নিষ্পত্তি করে দেওয়া আসলে প্রভাবশালীদের প্রশ্রয় দেওয়া। এতে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমা আক্তার জাহান কে একাধিক বার ফোন করা হলে রিসিভ হয়নি, এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া পাওয়া যায় নি ।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত

আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, খাস পুকুর থেকে অনুমতি ছাড়া মাছ উত্তোলন করা একাধিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

• খাস জমি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ১৯৯৭ (সংশোধিত ২০০৪) অনুযায়ী, ইজারা মেয়াদ শেষ হলে জমি বা জলাশয় পুনরায় সরকারের মালিকানায় ফিরে আসে। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি।

• বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ধারা ৪৪১ অনুযায়ী, সরকারি সম্পত্তিতে অবৈধ প্রবেশ ‘অপরাধমূলক অনধিকার প্রবেশ’ হিসেবে গণ্য হয়।

• একই আইনের ধারা ৪৪৭-এ বলা হয়েছে, এ অপরাধের শাস্তি হিসেবে জরিমানা বা এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া যেতে পারে।

• এছাড়া, সরকারের আর্থিক ক্ষতি সাধন করায় এটি দণ্ডবিধি ৪০৬ ও ৪০৯ ধারায় সরকারি সম্পদের অপব্যবহার বা আত্মসাতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

তাদের মতে, মাত্র চার হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া আইন ও ন্যায়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

গ্রামবাসীর দাবি

মুড়াইল গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সরকারি সম্পদ লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত করে আওয়ামী লীগ নেতা বোরহান উদ্দিন, তার সহযোগী ও বিএনপি নেতা ওয়াদুদ ফকিরসহ জড়িত সবার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

একজন গ্রামবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “সরকারি পুকুর থেকে কয়েক লক্ষ টাকার মাছ তুলে বিক্রি করা হলো, অথচ প্রশাসন সামান্য জরিমানা নিয়ে চুপ করে গেল। এটা জনগণের সঙ্গে প্রহসন।”

ঘটনাটি স্থানীয়ভাবে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং আইনের শিথিল প্রয়োগে সরকারি সম্পদ লুট হয়ে যাচ্ছে—এমন অভিযোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে। আইন বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষ মনে করছেন, এই ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের অপব্যবহার ও দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।